পোশাকীয় সমাচার
কারও ব্যক্তিগত পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আলাপ-আলোচনা আমার খুবই অপছন্দের। আর, কোন নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আলোচনা আরও অধিক অপছন্দের। ব্যক্তিগতভাবে আমি কারও পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে মাথা ঘামাই না। নিজের ক্ষেত্রেও যেটা ভাল লাগে সেটাই পরি। তবে, গতকালকে আমার এক ফেবু বন্ধুর পোস্টে ব্যাপারটা হঠাৎ করেই চলে এসেছে। এই বিষয় নিয়ে কিছু লিখবো সেরকম ইচ্ছাও ছিল না। তবে, আজকে আরও একজনকে দেখলাম এই বিষয়টা নিয়ে একটা পোস্ট শেয়ার দিয়েছে। তাই ভাবলাম এই বিষয় নিয়ে নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো শেয়ার করি।
বিষয়টা কী, সে সম্পর্কে আগে বলে নিই। ডেইলি স্টার ১১ বা, ১২ তারিখে খেলাধুলার একটা রিপোর্ট ছাপে। সেখানে দেখা যায়, পল্টন মাঠে বোরখা পরিহিতা এক ভদ্রমহিলা তাঁর পুত্রসন্তানকে নিয়ে খেলতে নেমেছেন এবং পত্রিকার রিপোর্টার সেই ছবি (যদিও বিষয়টা মূল খেলার সাথে প্রাসঙ্গিক না) রিপোর্টের অংশের সাথে জুড়ে দিয়ে ছেপে দিয়েছেন।
এই ছবি দেখে অনেকে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, কেউ কেউ এর মাঝে অনিন্দ্য সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছেন, ইত্যাদি। এই বিষয় নিয়েই গতদিন ফেবু বন্ধুটির সাথে কিছু বাতচিত হয়েছে। তবে, এখানে আর একটু বিস্তারিতভাবে কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি।
প্রথমেই বলেছি আমি কারও ব্যক্তিগত পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাই না। রাস্তাঘাটে কোন নারীকেও অযাচিতভাবে ‘ওড়না ঠিক করেন’ বা, ‘হিজাব ঠিক করেন’ -এই জাতীয় উপদেশ দিয়ে বেড়াই না। কাজেই, আমার ছবির বিষয়ে আপত্তির জায়গাটা ঠিক পোশাক নয়। বরং, এর ইনার মেসেজের প্রতি।
এই ছবিটির ঘটনাস্থল যদি পল্টন ময়দান না হয়ে আফগানিস্তানের কোন এক প্রত্যন্ত এলাকা হতো, তাহলে এর মাঝে আমি সৌন্দর্য খুঁজে পেতাম। কিন্তু, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ছবির মাঝে আমি অনিন্দ্য সুন্দর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ, বাংলাদেশের আর, আফগানিস্তানের সামাজিক প্রেক্ষাপট একরকম নয়। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন ফুটবল, ক্রিকেট থেকে শুরু করে ভার-উত্তোলনেও আন্তর্জাতিক পদক-পুরস্কার পাচ্ছেন। নানাক্ষেত্রে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, এই এগিয়ে যাওয়ার পথে তাঁদের প্রতিনিয়ত সামাজিক বাঁধার সাথে লড়াই করে এগুতে হচ্ছে। কিছুদিন আগেও কলসিন্দুরের পদকজয়ী মেয়েরা ফুটবল অনুশীলনের ক্ষেত্রে সমাজের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে বলে খবর এসেছে। নারীরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে বা, ট্রাউজার-জার্সি পরে এথলেট বা, খেলোয়াড় হওয়ার বাসনায় অনুশীলন করবে এ জাতীয় চিন্তা-ভাবনা সমাজ মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। নিজেদের না পারার অক্ষমতা আর, স্বপ্নহীনতার দায় ধর্মের শস্যক্ষেত্রের মোড়কে আবদ্ধ হয়ে নারীর অগ্রযাত্রাকে বরাবরই ব্যাহত করতে চায়। আর, সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ধর্ম। যে কারণে কোন নারী এথলেট বা, খেলোয়াড়কে খেলোয়াড় হিসেবে মূল্যায়নের আগে তার পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়টা খুব গুরুত্বের সাথে সামনে চলে আসে। আর, ইসলামি চিন্তা-চেতনায় বদ্ধমূল বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে এটা চরম প্রতিক্রিয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা বরাবরই নারীর পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে অতি উৎসাহী হয়ে থাকে এবং নারীর ‘প্রোপার ইসলামি ড্রেসকোডের’ ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচার-প্রচারণা চালায়। সেটা গৃহস্হালি, খেলার মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেটাই হোক না কেন। সবক্ষেত্রেই তাঁরা নারীদের শস্যক্ষেত্র বিষয়ক পরিচয়কেই মুখ্য জ্ঞান করে পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে অতি সংবেদী আচরণ করে। সেজন্য, পল্টন ময়দানে বোরখা পরিহিতা কোন নারীর ক্রিকেট খেলার দৃশ্য দেখে তাঁরা অতি উৎসাহ বোধ করে। তাঁরা বলতে চায়, সবক্ষেত্রেই নারী তার ‘প্রোপার ইসলামি ড্রেসকোড’ অনুসরণ করুক। কিন্তু, এই শ্রেণি আবার এটা বুঝে না খেলাধুলার ক্ষেত্রে ‘ইসলামি ড্রেসকোড’ বিষয়টা একেবারেই অসম্ভব। বোরখা পরে সুইমিং বা, দৌঁড় প্রতিযোগিতায় ‘ঈমানি যযবায়’ হয়তো অংশ নেয়া যাবে, তবে, ইহ জীবনে পদক-পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, এই শ্রেণির পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আমি উদার না কেন? আমি বিষয়টাকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখি না কেন? এই বিষয়টা বলার আগে, তাঁরা অর্থাৎ, ইসলামি আদর্শের বদ্ধ অনুসারীরা আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে কীরকম ধারণা পোষণ করেন সেটা অবশ্যই আপনার জানা উচিত।
আপনি কি কখনো ইসলামি জলসা বা, দ্বীনী পরিবেশে গিয়েছেন? যদি যেয়ে থাকেন তাহলে এখন যা বলবো সেই বিষয়টা একটু মিলিয়ে নিবেন। ধরুন আপনি কোন ‘দ্বীনী পরিবেশে’ প্যান্ট-শার্ট পরে অর্থাৎ, আপনার সাধারণ পরিচ্ছদে যেয়ে হাজির হয়েছেন। সেই পরিবেশে আপনি লক্ষ্য করবেন শুরুতেই ব্যাপক কিছু অনুসন্ধিৎসু চোখ আপনার পোশাকের ওপর বাঁকা দৃষ্টি রাখছে। তার ভিতর থেকে আরও কিছু অনুসন্ধিৎসু চোখ লক্ষ্য করছে আপনার প্যান্টের নিচের দিকে। সেটা যদি আপনার টাখনুর উপরে থাকে তাহলে তাঁরা স্বস্তিবোধ করবেন নয়তো, আরও কিছু অস্বস্তি তাঁদের ভেতরে বাসা বাঁধতে থাকবে। এরকম অবস্থায় তাঁদের কেউ কেউ যদি আপনার সাথে বাত-চিতে যায় এবং দেখে যে, আপনি তাঁদের চিন্তাধারার সাথে একাত্ম নন, তাহলে খুব দ্রুততার সাথে আপনার ব্যাপারে তাঁরা আবশ্যিক সিদ্ধান্ত টেনে নেবে। তাঁরা ধরে নিবে, আপনার দিলে (অন্তরে) মোহর লেগে গেছে এবং আপনার জন্য মহাশাস্তি সামনে অপেক্ষা করছে। এখন কোন মোহর পরা লোক সম্পর্কে বা, যার মহাশাস্তি প্রাপ্য হতে চলেছে, তার সম্পর্কে কোন শ্রদ্ধা বা, সম্মানের জায়গা তাঁদের মধ্যে কাজ করে কি? এখন তাঁরা যদি পোশাক-পরিচ্ছদের আলোকেই এক ধরনের প্রাথমিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন, তাহলে, আমাকে আপনি অসহিষ্ণু বলছেন কেন? শুরুতেই একবার বলেছি আমি কারও পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাই না।
যাহোক, মূল বিষয়ে ফিরে আসি। ডেইলি স্টারের সেই ছবির ব্যক্তিদের পরিচয় সম্পর্কে এবার একটু পরিচিত হই। ফেবু বন্ধুটির তথ্য মতে, ভদ্রমহিলার নাম ঝর্ণা এবং তিনি একসময় এথলেট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। (যদিও ডেইলি স্টারের রিপোর্টে শেষের তথ্যটা আমি পাইনি। হয়তো, তারা ইচ্ছাকৃত এই তথ্য বাদ দিয়েছে। নয়তো, বন্ধুটির তথ্যে ভুল আছে।) আর, বালকটির নাম সিনান। এই বালকটি পড়ছে স্থানীয় একটা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায়। অর্থাৎ, ইংরেজি-আরবি মিশিয়ে খিঁচুড়ি শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে বাংলার প্রাধান্য তলানীতে। এখন, এই দুটো তথ্য থেকে তাঁদের চিন্তা-ভাবনার যে দিকটি আমরা পাই সেটা কি খুব আধুনিক মনষ্ক? যে বালক বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায় পড়ছে এবং যে পরিবারটি তাকে এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছে তার বা, তাদের দ্বারা বাংলা সংস্কৃতি বা, এর ইতিহাস-ঐতিহ্যর উন্নয়ন বা, বিকাশে ধনাত্মক কোন ভূমিকা রাখা সম্ভব কি? এখানে অভিভাবকদের মতাদর্শ সম্পর্কে আমরা এক ধরনের ধারণা পাই। শিশু যেই পরিবেশ-পরিপার্শ্বে বেড়ে ওঠে, সে মোতাবেকই চিন্তাভাবনা করে। কাজেই, বালক সিনান যদি পরবর্তীতে এই দেশ ও জাতির ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ব্যাপারে ধনাত্মক কোন ভূমিকা রাখতে চায় সেক্ষেত্রে, তাকে তার প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ, পরিবারের মতাদর্শের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হবে। এই শিশু বালক সেটা পারবে তো বা, পারার মতো ইচ্ছাশক্তি তার মধ্যে জন্মাবে তো?
যাহোক, ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই অনেক পোশাক পরে খেলাধুলা করতে পারে। সেটা কোন সমস্যা না। তবে, দেশের জাতীয় একটা ইংরেজি দৈনিক যখন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেই বিষয়বস্তু পত্রিকায় প্রকাশ করে তখন সেই বিষয়টা নিয়ে ভাবনাচিন্তার কারণ অবশ্যই আছে। এখানে পত্রিকাওয়ালারা জেনেশুনে একটা বিতর্ককে টেনে নিয়ে এসেছে। এতে হয়তো তাদের কাটতি বাড়বে। তবে, সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলেই মনে করি। সবশেষে ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞানী Steven Weinberg এর একটা উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি-
“Religion is an insult to human dignity. With or without it you would have good people doing good things and evil people doing evil things. But for good people to do evil things, that takes religion.”
এখানে বলে রাখা ভাল, ব্যাপক বইপত্র ঘেঁটে বা, বিস্তর পড়াশোনা করে Steven Weinberg -এর এই উদ্ধৃতি আমি আবিষ্কার করিনি। বৃটিশ বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স এর একটা ডকুমেন্টারি আছে – ‘The God Delusion’ নামে। সেখানে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের মাথায় এই উদ্ধৃতির উল্লেখ আছে। উৎসাহী পাঠক ডকুমেন্টারিটা দেখে নিতে পারেন।
লিঙ্কঃ https://youtu.be/uQ7GvwUsJ7w
বিষয়টা কী, সে সম্পর্কে আগে বলে নিই। ডেইলি স্টার ১১ বা, ১২ তারিখে খেলাধুলার একটা রিপোর্ট ছাপে। সেখানে দেখা যায়, পল্টন মাঠে বোরখা পরিহিতা এক ভদ্রমহিলা তাঁর পুত্রসন্তানকে নিয়ে খেলতে নেমেছেন এবং পত্রিকার রিপোর্টার সেই ছবি (যদিও বিষয়টা মূল খেলার সাথে প্রাসঙ্গিক না) রিপোর্টের অংশের সাথে জুড়ে দিয়ে ছেপে দিয়েছেন।
এই ছবি দেখে অনেকে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, কেউ কেউ এর মাঝে অনিন্দ্য সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছেন, ইত্যাদি। এই বিষয় নিয়েই গতদিন ফেবু বন্ধুটির সাথে কিছু বাতচিত হয়েছে। তবে, এখানে আর একটু বিস্তারিতভাবে কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি।
প্রথমেই বলেছি আমি কারও ব্যক্তিগত পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাই না। রাস্তাঘাটে কোন নারীকেও অযাচিতভাবে ‘ওড়না ঠিক করেন’ বা, ‘হিজাব ঠিক করেন’ -এই জাতীয় উপদেশ দিয়ে বেড়াই না। কাজেই, আমার ছবির বিষয়ে আপত্তির জায়গাটা ঠিক পোশাক নয়। বরং, এর ইনার মেসেজের প্রতি।
এই ছবিটির ঘটনাস্থল যদি পল্টন ময়দান না হয়ে আফগানিস্তানের কোন এক প্রত্যন্ত এলাকা হতো, তাহলে এর মাঝে আমি সৌন্দর্য খুঁজে পেতাম। কিন্তু, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ছবির মাঝে আমি অনিন্দ্য সুন্দর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ, বাংলাদেশের আর, আফগানিস্তানের সামাজিক প্রেক্ষাপট একরকম নয়। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন ফুটবল, ক্রিকেট থেকে শুরু করে ভার-উত্তোলনেও আন্তর্জাতিক পদক-পুরস্কার পাচ্ছেন। নানাক্ষেত্রে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, এই এগিয়ে যাওয়ার পথে তাঁদের প্রতিনিয়ত সামাজিক বাঁধার সাথে লড়াই করে এগুতে হচ্ছে। কিছুদিন আগেও কলসিন্দুরের পদকজয়ী মেয়েরা ফুটবল অনুশীলনের ক্ষেত্রে সমাজের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে বলে খবর এসেছে। নারীরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে বা, ট্রাউজার-জার্সি পরে এথলেট বা, খেলোয়াড় হওয়ার বাসনায় অনুশীলন করবে এ জাতীয় চিন্তা-ভাবনা সমাজ মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। নিজেদের না পারার অক্ষমতা আর, স্বপ্নহীনতার দায় ধর্মের শস্যক্ষেত্রের মোড়কে আবদ্ধ হয়ে নারীর অগ্রযাত্রাকে বরাবরই ব্যাহত করতে চায়। আর, সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ধর্ম। যে কারণে কোন নারী এথলেট বা, খেলোয়াড়কে খেলোয়াড় হিসেবে মূল্যায়নের আগে তার পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়টা খুব গুরুত্বের সাথে সামনে চলে আসে। আর, ইসলামি চিন্তা-চেতনায় বদ্ধমূল বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে এটা চরম প্রতিক্রিয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা বরাবরই নারীর পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে অতি উৎসাহী হয়ে থাকে এবং নারীর ‘প্রোপার ইসলামি ড্রেসকোডের’ ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচার-প্রচারণা চালায়। সেটা গৃহস্হালি, খেলার মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেটাই হোক না কেন। সবক্ষেত্রেই তাঁরা নারীদের শস্যক্ষেত্র বিষয়ক পরিচয়কেই মুখ্য জ্ঞান করে পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে অতি সংবেদী আচরণ করে। সেজন্য, পল্টন ময়দানে বোরখা পরিহিতা কোন নারীর ক্রিকেট খেলার দৃশ্য দেখে তাঁরা অতি উৎসাহ বোধ করে। তাঁরা বলতে চায়, সবক্ষেত্রেই নারী তার ‘প্রোপার ইসলামি ড্রেসকোড’ অনুসরণ করুক। কিন্তু, এই শ্রেণি আবার এটা বুঝে না খেলাধুলার ক্ষেত্রে ‘ইসলামি ড্রেসকোড’ বিষয়টা একেবারেই অসম্ভব। বোরখা পরে সুইমিং বা, দৌঁড় প্রতিযোগিতায় ‘ঈমানি যযবায়’ হয়তো অংশ নেয়া যাবে, তবে, ইহ জীবনে পদক-পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, এই শ্রেণির পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আমি উদার না কেন? আমি বিষয়টাকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখি না কেন? এই বিষয়টা বলার আগে, তাঁরা অর্থাৎ, ইসলামি আদর্শের বদ্ধ অনুসারীরা আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে কীরকম ধারণা পোষণ করেন সেটা অবশ্যই আপনার জানা উচিত।
আপনি কি কখনো ইসলামি জলসা বা, দ্বীনী পরিবেশে গিয়েছেন? যদি যেয়ে থাকেন তাহলে এখন যা বলবো সেই বিষয়টা একটু মিলিয়ে নিবেন। ধরুন আপনি কোন ‘দ্বীনী পরিবেশে’ প্যান্ট-শার্ট পরে অর্থাৎ, আপনার সাধারণ পরিচ্ছদে যেয়ে হাজির হয়েছেন। সেই পরিবেশে আপনি লক্ষ্য করবেন শুরুতেই ব্যাপক কিছু অনুসন্ধিৎসু চোখ আপনার পোশাকের ওপর বাঁকা দৃষ্টি রাখছে। তার ভিতর থেকে আরও কিছু অনুসন্ধিৎসু চোখ লক্ষ্য করছে আপনার প্যান্টের নিচের দিকে। সেটা যদি আপনার টাখনুর উপরে থাকে তাহলে তাঁরা স্বস্তিবোধ করবেন নয়তো, আরও কিছু অস্বস্তি তাঁদের ভেতরে বাসা বাঁধতে থাকবে। এরকম অবস্থায় তাঁদের কেউ কেউ যদি আপনার সাথে বাত-চিতে যায় এবং দেখে যে, আপনি তাঁদের চিন্তাধারার সাথে একাত্ম নন, তাহলে খুব দ্রুততার সাথে আপনার ব্যাপারে তাঁরা আবশ্যিক সিদ্ধান্ত টেনে নেবে। তাঁরা ধরে নিবে, আপনার দিলে (অন্তরে) মোহর লেগে গেছে এবং আপনার জন্য মহাশাস্তি সামনে অপেক্ষা করছে। এখন কোন মোহর পরা লোক সম্পর্কে বা, যার মহাশাস্তি প্রাপ্য হতে চলেছে, তার সম্পর্কে কোন শ্রদ্ধা বা, সম্মানের জায়গা তাঁদের মধ্যে কাজ করে কি? এখন তাঁরা যদি পোশাক-পরিচ্ছদের আলোকেই এক ধরনের প্রাথমিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন, তাহলে, আমাকে আপনি অসহিষ্ণু বলছেন কেন? শুরুতেই একবার বলেছি আমি কারও পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাই না।
যাহোক, মূল বিষয়ে ফিরে আসি। ডেইলি স্টারের সেই ছবির ব্যক্তিদের পরিচয় সম্পর্কে এবার একটু পরিচিত হই। ফেবু বন্ধুটির তথ্য মতে, ভদ্রমহিলার নাম ঝর্ণা এবং তিনি একসময় এথলেট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। (যদিও ডেইলি স্টারের রিপোর্টে শেষের তথ্যটা আমি পাইনি। হয়তো, তারা ইচ্ছাকৃত এই তথ্য বাদ দিয়েছে। নয়তো, বন্ধুটির তথ্যে ভুল আছে।) আর, বালকটির নাম সিনান। এই বালকটি পড়ছে স্থানীয় একটা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায়। অর্থাৎ, ইংরেজি-আরবি মিশিয়ে খিঁচুড়ি শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে বাংলার প্রাধান্য তলানীতে। এখন, এই দুটো তথ্য থেকে তাঁদের চিন্তা-ভাবনার যে দিকটি আমরা পাই সেটা কি খুব আধুনিক মনষ্ক? যে বালক বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায় পড়ছে এবং যে পরিবারটি তাকে এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছে তার বা, তাদের দ্বারা বাংলা সংস্কৃতি বা, এর ইতিহাস-ঐতিহ্যর উন্নয়ন বা, বিকাশে ধনাত্মক কোন ভূমিকা রাখা সম্ভব কি? এখানে অভিভাবকদের মতাদর্শ সম্পর্কে আমরা এক ধরনের ধারণা পাই। শিশু যেই পরিবেশ-পরিপার্শ্বে বেড়ে ওঠে, সে মোতাবেকই চিন্তাভাবনা করে। কাজেই, বালক সিনান যদি পরবর্তীতে এই দেশ ও জাতির ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ব্যাপারে ধনাত্মক কোন ভূমিকা রাখতে চায় সেক্ষেত্রে, তাকে তার প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ, পরিবারের মতাদর্শের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হবে। এই শিশু বালক সেটা পারবে তো বা, পারার মতো ইচ্ছাশক্তি তার মধ্যে জন্মাবে তো?
যাহোক, ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই অনেক পোশাক পরে খেলাধুলা করতে পারে। সেটা কোন সমস্যা না। তবে, দেশের জাতীয় একটা ইংরেজি দৈনিক যখন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেই বিষয়বস্তু পত্রিকায় প্রকাশ করে তখন সেই বিষয়টা নিয়ে ভাবনাচিন্তার কারণ অবশ্যই আছে। এখানে পত্রিকাওয়ালারা জেনেশুনে একটা বিতর্ককে টেনে নিয়ে এসেছে। এতে হয়তো তাদের কাটতি বাড়বে। তবে, সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলেই মনে করি। সবশেষে ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞানী Steven Weinberg এর একটা উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি-
“Religion is an insult to human dignity. With or without it you would have good people doing good things and evil people doing evil things. But for good people to do evil things, that takes religion.”
এখানে বলে রাখা ভাল, ব্যাপক বইপত্র ঘেঁটে বা, বিস্তর পড়াশোনা করে Steven Weinberg -এর এই উদ্ধৃতি আমি আবিষ্কার করিনি। বৃটিশ বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স এর একটা ডকুমেন্টারি আছে – ‘The God Delusion’ নামে। সেখানে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের মাথায় এই উদ্ধৃতির উল্লেখ আছে। উৎসাহী পাঠক ডকুমেন্টারিটা দেখে নিতে পারেন।
লিঙ্কঃ https://youtu.be/uQ7GvwUsJ7w
Share